মিলছে না। তবে যে শিখিয়েছিল সেই সব প্রতিজন যারা ছিল আশেপাশের , কাছের, অন্তত মা-বাবা এবং শিক্ষক কূল তো বটেই। একটা শিশুর শৈশব সরলতা আর জ্ঞানের অপরিপক্কতার সুযোগ নিয়ে কেবল তত্ত্ব ও তত্ত্বই শিখিয়ে গেলো, তবে কি তারা বোকা ছিলো নাকি ভেবেছিল সমাজের বিভ্রান্তির এই স্ব বৃদ্ধিমান জালখানি দূর হয়েই যাবে, নাকি শৈশবে এমন কিছু দেখেছিল আমাদের মধ্যে আমরা সব সুপারম্যান হব পরিপক্ক মানব হবার কালে। অথচ তারা কখনই সেই সত্যটা মানেনি, মানেনি মানুষ কখনও একা একা সুপার ম্যান হয় না, হয়নি কখনই। যা গল্প সুপারম্যান কূলের সবই কল্পনা, আজ বর্তমান থেকে এই পূর্ণ যৌবন কালে যে বাস্তবতা দেখি তাতে যেমন কল্পনা সেই শৈশবের সব নীতিশাস্ত্র পাঠ, ঠিক তেমনি ।
বড্ড কষ্ট, বড্ড অমিল। শৈশবে মাথা পেতে , মনের দূরন্ত নাচনের ইচ্ছা ছেড়ে, মুক্ত আকাশে নাটাই ঘুড়ির হাতছানি ভুলে সব নীতি বাক্য আপ্ত করতে কাটালাম পুরো কাল, তারপর পরীক্ষার পর পরীক্ষার ফলাফল সন্তষজনক বানিয়ে বাবা-মা, চাচা-মামা, আর শিক্ষক কূলের মুখে হাসি ফুটিয়েস শৈশবের কচি জীবন ডালটিকে ভারী আর দৃঢ় বানিয়ে কলেজে উঠলাম, ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ট কলেজ- ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। ওমা! এইচ এস সি পরীক্ষার একদিন- কত কষ্টে সব পাঠ বুঝে আর মুখ বুজে মুখস্ত করে পরীক্ষা দেবার আগের রাতে শুনি, পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। চাচা বলল, ঠিকাছে, সরকার পতনের জন্য তোদের মত ভবিষ্যত প্রজন্মকে পরীক্ষা আরেকদিন দেবার ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে, আর মামা বললেন, ছিঃ ছিঃ ছোট ছোট বাচ্চাদের পরীক্ষাও দিতে দিচ্ছেনা এরা, কত জঘন্য! আমি কিন্ত শৈশবের কচি ডালখানা ছেড়ে এগিয়ে চলেছিলাম, আমি কিন্তু বুঝেছিলাম এই হরতাল আর পরীক্ষা পেছানোর কাহিনীর মধ্যে কোন নতুনত্বই আসলে নেই, এ চিরন্তন, এবং সেই ভাবনার বাস্তব দর্শণ ঠিকই চলছে এখনও। তাহলে সেই চাচা-মামার কাছে শেখা শৈশবের একটি দুটিও নীতি বাক্য আমি আজ আর কেনো মানবো!
মানিনি, মানিনি বলেই তো আজ এখানে। এ অনেক ভালো। এ শৈশবের স্বপ্ন আর যৌবনের বাস্তবতার ফারাক হতে তো দূরে রেখেছে।
অন্তত এখানে আমাকে হাসপাতালে মাত্র একটি সিট পাবার জন্য নিজ হাতে গিয়ে এটেন্ডেন্টকে ঘুষের টাকাটা দিয়ে আসতে হবেনা। বাবা সরকারী ভুমি অফিসের কোন একটা ছোট পোষ্টে চাকুরী করতেন। মা’র একটা ছোট সার্জারি করাতে হয়েছিল, তখন জানতাম না, পরে জেনেছিলাম ওটা ছিলো জরায়ু অপসারণ করার অপারেশণ। সরকারী হাসপাতালে যাবার সেই প্রথম অভিজ্ঞতায় দুর্নীতির ঘনঘটা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। সরকারী লোক, সরকারী হাসপাতাল তবুও টাকা ছাড়া কেউ এক বিন্দু সেবা যেন করতে চাচ্ছিল না। তবে যে এত নীতি বাক্য শেখালো বাবা শৈশবে। সেই বাবা প্রতি পদে পদে কখনও নিজে কখনও আমাকে দিয়ে দুহাতে টাকা ঢালছে। তবে তাতে মা’র চিকিৎসাটা খুব ভালো হলো। তিনি খুব আরামে থাকলেন। আমি পরে হিসেব করে দেখেছি, যে ক’টাকা বাবা ঘুষ বা বাবার ভাষায বখশিশ দিয়েছিলেন তার পুরোটা যোগ করলে যা হবে বাবার বেতন তার চেয়ে ঢের কম। বেতনের এই হিসেবটা আমার হয়তো কখনই জানা হতো না। ঢাকা ভার্সিটি থেকে তীব্র রাজনৈতিক যন্ত্রনার কারেন্ট জাল ছিন্ন করে ইকোনমিক্সে যখন প্রথম শ্রেণী পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হলাম বাবার প্রচন্ড চাপ আমার উপর টের পেলাম-আমাকে বিসিএস পরীক্ষা দিতেই হবে। বাধ্য হয়ে বিস্তারিত খোঁজ করার একটা প্রয়াসে দেখি যে বেতন আমাকে সরকার একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে দেবে তার চেয়ে ঢের আমি স্টুডেন্ট লাইফে টিউশনি করেই কামাতে দেখেছি আামর আশেপাশের বহু পোলাপানকেই। আমার হাত খরচ অবশ্য বাবা সর্বদা যথেষ্ট পরিমাণেই দিয়ে এসেছেন। টিউশনি করতে হয়নি, লোকাল বাসে কখনও উঠতে হয়নি। অবাক হলাম যখন দেখলাম একজন ছোট কর্মচারীর বেতনের যে হাল তাতে তার ছেলে রোজ রিকশায় বা অটো করে ভার্সিটিতে পরার কথাই নয়। তার উপর ঢাকা শহরে আমাদের একটা পশ এরিয়াস্থ এপার্টমেন্টও আছে। ভেবেছিলাম সরকার বোধহয় এসব কেনার লোনটোন দেয়, সে সবও যে অলিক তাও জানলাম এই এক বিসিএস দেয়ার চক্করে।
মা'র যখন অপারেশন চলছিল আমার ছোট বোনটা তখন খুবই ছোট। মাত্র বছর চার হবে তার বয়স। ওর নাম খুব মিষ্টি। আমার সাথে খুব মিল রেখে নাম রেখেছিল মা। সীমান্তের বোন সীমা। বাসায় এক দূর সম্পর্কের খালাকে আনা হয়েছিল, সীমা তার কাছেই থাকত। আমি মা'র অবর্তমানে সীমাকে শৈশবের অকারণ এবং বাস্তবতা বিবর্জিত সেই নীতি জ্ঞান তার জন্য উজাড় করে দিতাম। সে ভাবত, ভাইটা তার কত ভালো। কত ভালো ভালো শিক্ষা দেয়। যদিও শৈশবের দূরন্তপণা তাকে মাঝে মাঝে সেই সব আপ্ত বাক্য বিরক্তি এনে যে দিত না , তা একেবারে ঠিক না। তবুও সে আমাকে মানত। সে আমার মত হতে চাইতো। সে পড়া শুনায় বেশ মনোযোগীই ছিলো। তাকে শেখানো সকল পাঠের উত্তম পাঠ-সত্য বলার পাঠ সে মেনে চলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। আমাকে বলেছিল, আমি আর বাবা হাসপাতালে গেলে একটা লম্বা চুল ওয়ালা লোক বাসায় আসত। তাকে টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে তারা দু’জন দরজা বন্ধ করত। আমি তখন নিতান্তই ছোট সেই দেহ শাস্ত্র বোঝার পথে। তাই পুরো বুঝিনি। প্রেম প্রেম গন্ধ টা বুঝি। তবে বুঝিনা বাবাকে কিভাবে জানাবো, কিংবা আদৌ জানবো নাকি না। শেখা কোন জ্ঞান সিদ্ধান্ত নিতে দিচ্ছিল না। সত্য কথার পাঠ বলছিল এখুনি জানাও, আবার মনে হচ্ছিল, খালাকে না জিজ্ঞাস করে বললে উনি আবার কি মনে করেন, ওনার বন্ধুতো আসতেই পারে, নাকি!
অবশেষে সত্য বলার মানসে বাবাকে বলেছিলাম। বলেছিলাম দরজা বন্ধ করা বিষয়টাও। এর একদিন পরেই সীমা আমাকে বলেছিল, বাবাও খালাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল অনেকটা সময়, একদিন না পর পর দুদিন। এইবার আমি এ কথা কাকে জানাবো তা আর ভেবে পাইনি। তবে খালাকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম। অবশ্য মা ফেরার পর বাবা সেই ছেলেটির সাথে খালাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। আমি সত্যটা খালার মুখ থেকে একদিন জেনেছিলাম, জেনেছিলাম খালাকে সেই ছেলেটার সাথে ইনডিসেন্ট সম্পর্কর খবরটা বাবার অন্তরে চেপে রাখার জন্য এবং তাদের বিয়ে দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি পূরণে কতবড় পাপ করতে হয়েছিল বাবার সাথে।
আমি কিন্তু সত্যবাদ যুঠিষ্টার সেদিন আর হতে পারেনি সেই জঘন্য কথা জেনে। সেদিন আমার কোন শৈশবের পাঠ আমাকে অন্তর্জালা হতে বাঁচাতে পারেনি। আবার আমিও উল্টো করে ভেবেছিলাম, খালা আমাকে কেনো বলেছিল সে কথা। এ কি নিজের মত করে তার প্রশান্তি পবার পথ! জটিল, পুরো সমাজটাই জটিল।
আবার সেই বাবাই যখন সীমাকে তার ক্লাশ টেনে পড়ার সময় শুনলেন এক ছেলের সাথে তাকে ঘুরতে দেখা যায় রোজ; দিব্যি রেগে গেলেন, জানতে চাইলেন, সেই সত্যবাদী সীমা দিব্যি চেপে গেলো। সব অস্বীকার করল। অথচ আমি নিজে দেখেছি সেই ছেলের সাথে তার প্রেম এখনও চলছেই। সীমার জন্য আমার গর্ব হয়। সত্য কথা বলে অন্তত আমার মত প্রেম বর্জিত হতে হলো না। প্রেম বর্জনের সে ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। সংক্ষেপে বললে একটা মেয়ে ছিলো, খুব ভাল লাগত। দুদিন কথা বলতেই বাবা মেয়েটার বাবাকে হুমকি দিয়ে এলেন । বাবার এক ঘণিষ্ট বন্ধু ছিলো পুলিশ ইনেসপেক্টর। তার দাপাটে বাবার দাপটটা বেশ কাজে লাগতো। মেযেটাকে তার বাবা খুব বকেছিলো। জীবনে আর আমার দিকে ঘুরে তাকায়নি। আমি ও ভালোবাসাকে জীবনের মত যেন কবর দিয়ে দিয়েছিলাম।
যে বাবাকে এত ভয়, সেই তার কথা শুনলাম না। বিসিএসটা দেবো না জানিয়ে দিলাম। বাবা ক্ষ্যাপলেন। আমি বুঝাতে পারলাম না। বললাম আমি একটা কোন ব্যাংক বা বিদেশি কোম্পানীতে চাকুরী জুটিয়ে নেবো । তিনি হাসলেন। বললেন, খালি বেতন দেখলি! স্ট্যাটাস দেখলি না। আমি মনে মনে বললাম , হুম আর দুর্নীতিটাও তো দেখলাম বাবা। মুখে বলতে পারলাম না। উনি আরও বললেণ- প্রাইভেট চাকুরী, ওত সহজ না পাওয়াটা বাপধন।
আমি শুনে চুপ করে কেটে পরলাম।
রাগে সে রাতে ভার্সিটির হলে গিয়ে থেকেছিলাম। হলে তখনও কিছু ক্লাশমেট থাকত। ওরা ছাত্র নেতা। ওরা কবে ভর্তি হয়েছে আর কবে পাশ করবে আমি জানতাম না। শেয়ার করলাম। আসলে বাবাকে তো বললাম। কিন্তু চাকুরী পাবা কি আর এত সোজা। বাবাতো আর হেল্প করবেন না। অন্য বন্ধুদের বাবাদের দেখেছি আত্মীয় স্বজন ধরে বড় বড় ব্যাংক বা কোম্পানীতে ঢুকিয়ে দিছ্ছে। আমি আত্মীয় পাব কোথায়, বাবা কেবল টাকাই বানিয়েছে যেমন করেই হোক, আত্মীয়টা বানাতে পারেনি।
ছাত্র নেতা এক সহপাঠী বন্ধু বলল, দূর! চাকুরীর চিন্তা করিস কেনো, যার আন্ডারে রাজনীতি করি উনি নিজেই দুটো ব্যাংকের ডিরেক্টর। তিনি টাকা নেবেন না তো। তবে তার পিএকে দিয়ে তো বলাতে হবে। বেশি না, আমার বন্ধু তুই, লাখ খানেক জোগার করে দে। চাকুরী নিশ্চিত।
আমার ভাবনার দীর্ঘ বলি রেখা মুখে দেখে সে বলেছিল, দূর বেতন পাবর পর মনে হবে ও টাকা কোন টাকাই না।
আমি বললাম, না ঘুষ দিয়ে চাকুরী করব!
সে হাসতে হাসতে বলেছিল, তোর বাবা যেন সরকারী অফিসের কি পদে আছেন, তোদের শুনেছি একটা এপার্টমেন্টও আছে বেশ বড় সড়...
আমি মাথা নেড়েছিলাম কেবল। বলেছিলাম, চাকুরী নিশ্চিত হলে আমি টাকা দেবো।
বাবার কাছে টাকা চাইবার সাহস আমার হয়নি। শৈশবের পাঠ আর বাস্তবতা আমাকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছিল। বরং ঐ দরিদ্র হীন পথকলি ছেলে পেলে গুলোই বেশ ভালো। জীবনটাকে তারা শৈশব থেকেই সঠিক বাস্তবতার নিরিখে দেখে আর শেখে আর আমরা যারা মোটামুটি নন্দ দুলালের লেবাষ পরে শৈশবে সব অনর্থক পাঠ শিখি আমরাই আসলে দুমুখো সাপ।
আমি ভাবতে দেরি করিনি। শৈশবের নীতি শাস্ত্রের ভীত এত মোটা আর বিস্তৃত যে তার উপরে অনায়াসে দাঁড়িযে এই ঘুনেধরা নোংরা সমাজে যে কোন সীদ্ধান্তের সীমান্তে পৌঁছাতে এই সীমান্ত আমার মোটেও সময় লাগে না। সেদিনও লাগেনি।
একটা অস্ত্র জোগাড় করতেও এই শহরের বুকে আমার বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। সেটা নিয়ে ভার্সিটির ভেতরেই দিন দুপুরে সোনালী ব্যাংক হতে দুলাখ টাকা নিয়ে বের হওয়া এক ব্যক্তিকে ঠেকিয়ে দিলাম।
ছাত্র নেতাকে তার অর্ধেক দিয়ে চাকুরীটাও প্রায় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে অনুশোচনা হচ্ছিল। কিন্তু শৈশবের নানান জটিল নীতির পাঠ বাঁচিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল সেই পাঠ- আমি আর পিস্তল ঠেকিয়ে কত নিয়েছি, কাগজ কলম আটকে নিকট কাছের কত জনই এর ঢের নিচ্ছে, কত এপার্টমেন্ট কিনছে আর বড় করছে আমার মত শিক্ষিত জটিলতায় ভরা এক প্রাণ।
চাকুরীটা হয়নি। ছাত্রনেতাটি চাপাতির কোপে আহত হয়ে হাসপাতালে পড়েছিল। দলীয় কোন্দল। সেই সব দেখতে দেখতে কখন যেন আবার পিস্তলটা নিয়ে আরেকবার ঠেক দিয়েই ফেললাম।
সেবার আর রক্ষে হয়নি। বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলো শুনেছি। দেখা করতে আসেনি জেলে। সীমা এসে মাঝে মাঝে কাঁদত।
আজ আমার ছেড়ে দেবার দিন। ছাত্র নেতা আমাকে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সাহায্য করেছিল। আমার ছিনতাই কেসটা প্রমাণ হয়নি। করবেই বা নাকেনো। আমার সেই দুলাখের পুরোটাই সে সেই ছাত্র নেতার চিকিৎসয় ব্যয় হয়েছে। সে বলেছে কদিন গেলে একটু পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে চাকুরীর ব্যবস্থা করেই দেবে। টাকা লাগবে না। আমি জানি ও লাইনে একবার পরে গেলে সময় লাগে।
...সে যাক। জেল থেকে বের হয়ে আমি শাহবাগ মোড়ে কয়েকটা পথকলি শিশুকে রোজ ফলো করি। বাসায় ফিরবো না ঠিক করেছি। ঠিক করেছি ঐ পথশিশুগুলোর সাথে থেকে থেকে শৈশবের পাঠ নতুন করে নেবো।